17 Dec 2024, 12:52 pm

বদলে যাচ্ছে সততার সংজ্ঞা —-এম এ কবীর (সাংবাদিক)

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

সততা- নৈতিকতার সঙ্গে মনের একটা গভীর সম্পর্ক কিংবা যোগাযোগ আছে;যা পরিবারের সংস্কার থেকে বংশানুক্রমে আসে। তাই যে কারোর বিবেকের মৃত্যু দেখে খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হচ্ছে বিবেককে কে মেরেছে? মেরেছে পরাধীনতা। কোন পরাধীনতা? আমরাতো স্বাধীন। আসলে কী তাই? চোখ বুজে শান্ত মনে একটু ভেবে দেখুন। কী চেয়েছিলাম, কী পেলাম? আমাদের যার যতটুকু আছে,তাতে আমরা সুখি নই। আমাদের শুধু ব্যক্তিগতভাবে সৎ থাকলে চলবে না,দায়িত্ব পালনও করতে হবে। দায়িত্ব পালন না করলে সততার মূল্য থাকবে না। এর ফলে সাধারণ প্রতিবাদী মানুষ লড়াই করতে করতে এক সময় হতাশ হয়ে পড়বে।
তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনেটারী ইন্সপেক্টর। নারায়ন চন্দ্র দাদা। গত ২৪ জুলাই সন্ধ্যায় শহরের গীতাঞ্জলী সড়কে এক চা এর দোকানে আমাকে কাছে পেয়ে বললেন আপনার লেখা আমার খুব পছন্দের। বেশ কিছু দিন আপনার লেখা পাচ্ছি না। সেখানে আসেন নাসিম উদ্দীন। একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী নেতা। খুবই মিশুক। যাকে কাছে পান তাকেই এক কাপ চা অফার করেন। দুজনে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলাপ চারিতায় মেতে উঠেন। সৎ সাংবাদিকতার বিষয়ও বাদ যায়নি। একে একে অনেকেই যোগ দেন সেই আড্ডায়। আলোচনার বিষয় বস্তু এক জায়গায় থাকেনি। মানুষের সততা, সৎ থাকা নিয়েও উঠে আসে আলোচনা, সমালোচনা। কোন মানুষই যে পুরোপুরি সৎ নয়,সৎ থাকতে পারে না তা নিয়ে বিতর্ক বেশ জমে ওঠে। সেই আলোচনার রেশ ধরেই দুটো কথা বলা দরকার।
কারো স্বার্থহানি না করে নৈতিক মানদন্ডে যা গ্রহণযোগ্য, সে কাজই ন্যায়সঙ্গত। এরই নাম সততা। বাহ্যিকভাবে যা আইনের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং ধর্মীয়ভাবে স্বীকৃত তাই বৈধ। মানবীয় জ্ঞানে সততার সংজ্ঞা একটি বিতর্কিত বিষয়। অমীমাংসিত প্রসঙ্গ। সময় ভেদে ভিন্ন ভিন্ন সমাজে কিংবা রাষ্ট্রে সততার সংজ্ঞা আলাদা। যার সুনির্দিষ্ট ও সুনিরূপিত কোনও সীমারেখা টানা নেই। আমরা সবাই কমবেশি অসৎ হই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। সততা কী এবং কাকে বলে- এ ভাবনা সংবেদনশীল মানুষকে অনবরত তাড়িত করে। আলাদা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে প্রত্যেক মানুষের কাছে সততার সংজ্ঞা ভিন্ন। একজনের কাছে যা স্বাভাবিক, আর একজনের কাছে তা অন্যায়, অন্যজনের কাছে তাই পাপ। ফলে মনে হওয়া স্বাভাবিক; সততা প্রথমে জিনগত। তারপর পরিবারগত। এরপর পরিবেশগত। সর্বশেষ শিক্ষাগত।

সততার সংজ্ঞা যে সবার কাছে এক নয় তার একটি উদাহরণ দেয়া যায়। বলছি আমার এক সহপাঠীর গল্প। সেই সহপাঠীর লক্ষ্য ছিল জীবনে সে অনেক সম্পদের মালিক হবে। ধনীর খাতায় নাম লেখাবে। এটা ছিল তার একমাত্র চাওয়া। কিন্তু ধান্ধা ছাড়া অর্থ কামানো যায় না- এ কথা তার মনে কৈশোর থেকেই গেঁথে যায়। এতে চিত্তশূন্য করতে কোনো দ্বিধা করেনি সে। ব্যক্তিজীবনে আমরা কতটা সৎ তা-ও জানি না। আমরা কেউ সম্পূর্ণ সৎ কোনো দিন হতে পারব কিনা সেটিও অজানা। পরিস্থিতি কাউকে কাউকে কখনো কখনো অসৎ করে দিতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, সহপাঠী ধান্ধা করবে। কিন্তু সমাজের চোখে নিজেকে অসৎ হিসেবে পরিচিত করতে নারাজ। কোনো মতে পাস কোর্সে ডিগ্রি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কিভাবে টাকা কামানো যায় সেই ফিকিরে নেমে পড়ে। কর্মজীবনের শুরুতে প্রথমে সৎ উপায়ে পরিশ্রম করে টাকা উপার্জনের চেষ্টা করে। যোগ্যতা-দক্ষতা তেমন না থাকায় খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। তাই বাঁকা পথে এগোয়। না হলে জীবনের লক্ষ্যচ্যুতি ঘটবে যে। লক্ষ্য মাফিক তার পথচলা। বলে রাখা ভালো, তার পথচলা কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে নিন্দা কুড়োয়নি। হয়েছে সমাদৃত। কিভাবে ? সে কথাই বলা দরকার।
বলেছি, অর্থবিত্তের মালিক হতে শুরুতে সে পরিশ্রমের পথে হাঁটে। দেশে সুবিধে হবে না বিধায় পৈতৃক জমি বিক্রি করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে পাড়ি জমায়। সেখানে তীব্র গরমে অমানুষিক পরিশ্রম করেও কাঙ্খিত অর্থ না মেলায় দেশে ফিরে আসে। এবার একটু কৌশলী হয় সে। কায়দা-কানুন করে কোনোমতে ট্যুরিস্ট ভিসায় সিঙ্গাপুরে যায়। এই ট্যুর নির্মল আনন্দ লাভের জন্য নয়। মতলবি সফর। ফিরে এসে ঘোষণা করে সিঙ্গাপুরের একটি নির্মাণপ্রতিষ্ঠানের সাথে তার চুক্তি হয়েছে। কোম্পানিটির যত নির্মাণশ্রমিক লাগবে সে সরবরাহ করবে। নির্ভুল ইংরেজি বলার দক্ষতা থাকায় এর সুবিধা সে অর্থ কামানোর কাজে ব্যয় করে। শুধু ইংরেজি জানায় মানুষজন তার কথা সহজে বিশ্বাস করে। তত্ত্বীয় ব্যাখ্যায় বলা যায়, কলোনিয়াল মেন্টালিটির প্রভাব। যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যে কঠোর পরিশ্রমেও কাঙ্খিত টাকা আয় সম্ভব নয়,অন্য দিকে সিঙ্গাপুরে গিয়ে খাটলে বেশি অর্থ পাওয়া যায়, তাই অভিবাসনপ্রত্যাশী অনেক তরুণ তার পিছু পিছু ঘুরতে থাকে। সেও মিষ্টি কথায় গোটা ৩০ জনকে শিকারে পরিণত করে। ধার-কর্জ, জমি-জিরাত বিক্রি করে প্রত্যেকে ১০ লাখ টাকা করে জমা দেয়। এত সে তিন কোটি টাকা সংগ্রহ করে মাস তিনেকের মধ্যে। ‘পরের ধনে পোদ্দারি’ বলে একটা কথা আছে। এটি আরো পোক্ত করে সিঙ্গাপুরে প্রবাসী এক বাংলাদেশীর কাছ থেকে। গুরুর কথার বাইরে একচুলও যায়নি সে। মক্কেলদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার পর পুরোটাই ব্যাংকে রাখে। এরপরই ভেলকিবাজি শুরু। যারা সরল বিশ্বাসে টাকা দেয়, তারা পেছন পেছন ঘুরতে থাকে। ভিসা আর আসে না। এভাবে কিছু দিন যাওয়ার পর সে লাপাত্তা। সবাই মনে করে, সমুদয় টাকা মেরে সে গায়েব হয়েছে। না তা হয়নি। ছয় মাস পর ফিরে এসে বলে সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলাম চুক্তিবদ্ধ কোম্পানির সাথে কথা বলতে। খুব শিগগির ভিসা আসবে। এমনি করতে করতে বছর তিনেক চলে যায়। তবে বিশ্বাসের সুতোয় যাতে টান না পড়ে সে বুদ্ধিও তার ছিল ষোলোআনা। ৩০ জনের মধ্যে পাঁচজন তার ভাষায় অস্থিরমনা। তাদের পুরো টাকা ফিরিয়ে দেয়। বাকি ২৫ জন। তারা ভাবে, বেশি চাপাচাপি করলে তাদের টাকাও ফেরত দেবে। শেষে সাধের সিঙ্গাপুর যাওয়া হবে পন্ড। স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় তারা দগ্ধ হতে চাননি। পরে জানা যায়, আসলে ওই ২৫ জনের পরিবার এলাকায় নিরীহ গোছের। আর যে পাঁচজনের টাকা ফেরত দেয়; তারা প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান। তাদের সামাল দেয়া যাবে না বিধায় টাকা ফেরত দেয়া। অথচ এটিই সততার বর্ম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে একথা সত্য যে, পরবর্তী পাঁচ বছরে সবার টাকা কড়ায় গন্ডায় শোধ করে দেয়। টাকা শোধ করায় এলাকায় অন্যসব আদম ব্যাপারির চেয়ে আলাদা মর্যাদায় সমাসীন হয়। কেন এই মর্যাদা? কারণ, যেখানে অন্যসব আদম ব্যাপারি পুরো টাকা মেরে দেয়; সেখানে সে এক পয়সাও আত্মসাৎ করেনি। এ জন্য ৩০ জনের পরিবারসহ এলাকার অনেকের কাছে তার সততা পরীক্ষিত বলে প্রমাণিত হয়। তবে ৩০ জনের টাকা কয়েক বছর আটকে ব্যাংকে গচ্ছিত রাখায় যে সুদ আসে তা আর কাউকে ফেরত দেয়নি। সব লাভ সে নিজের মনে করে। এ অর্থই এখন তার পরিবহন ব্যবসার পুঁজি। এই যে একজন প্রতারক কূটকৌশলে ব্যবসার পুঁজি সংগ্রহ করল, এর পরও জনমানসে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি। উল্টো তার প্রতারণাকেও যখন অবৈধ মনে করা হয় না, তখন সৎ মানুষের মর্যাদা ধুলায় লুটিয়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। সাধারণত জীবন চালানোর চেয়ে বেশি অর্থ জমা থাকার অর্থ-অনিবার্যভাবে অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ন করা। সম্প্রতি ওই সহপাঠীর সাথে দেখা হলে আলাপচারিতায় তার ব্যবসায়ের হাল-হকিকত জানা যায়। দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে চলাচলরত গোটা দশেক বাসের মালিক সে। সেই আয়ে রাজসিক জীবনযাপন। আর এলাকায় এখনো একজন সৎ জনশক্তি রফতানিকারক হিসেবে পরিচিতি লাভ তো উপরি পাওনা।
একজন কূটিল প্রতারকের কাহিনী নমুনা হিসেবে পেশ করার কারণ, দেশে এখন ঋণের নামে ব্যাংক থেকে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া হচ্ছে। কিংবা অনেকে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের ঠিকাদারি পেয়ে যেনতেনভাবে কাজ শেষে হাতিয়ে নিচ্ছেন বিপুল অর্থ। সেই অর্থে দেশ-বিদেশে বিলাসী জীবন কাটাচ্ছেন। এসব দুর্নীতিবাজ অনেকে আবার বিপুল অর্থ খরচ করে জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন। আরো ফুলেফেঁপে উঠছেন। এসব অপকর্ম করার তারা অবাধ লাইসেন্স পাচ্ছেন খুদ-কুঁড়োর বিনিময়ে। মানে কিছু টাকা ছিটিয়ে। এক্ষেত্রে সরকারি কিছু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করছেন ঘুষ দিয়ে। আর সামাজিক বৈধতা নিচ্ছেন জনকল্যাণের নামে। এতেই তাদের নামে চারিদিকে ধন্যি ধন্যি রব উঠছে। আমজনতাও তাদের জনকল্যাণের জয়ধ্বনি দিচ্ছেন। এই যে জনমানসে বিকৃতি এতে ন্যায়-অন্যায় এবং বৈধ-অবৈধের ভেদরেখা মুছে যাচ্ছে। সততার সংজ্ঞাও বদলে যাচ্ছে। সামাজিক বৈধতা পাল্টে দিচ্ছে মানুষের মানসিক গঠন।
সততা, নীতি-নৈতিকতার বিষয়ে জনমানসে অলক্ষ্যে যে পরিবর্তন ঘটে গেছে, চারদিকে একটু খেয়াল করলে তা অনুভবে আসে। চোখ-কান খোলা রেখে যে কেউ সাদা চোখে দেখতে পাবেন এই পরিবর্তন। তখন অনুধাবন করতে পারবেন সর্বজনীন নৈতিকতার ভিত কতটা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। ঘুণ পোকায় আসবাবপত্র খাওয়ার মতো আর কী! অবস্থা এত শোচনীয় যে, যেকোনো সময় হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। মেরামতের ফুরসত মিলবে না। এ জন্য নৈতিকতার লড়াই জোরদার করা চাই। নৈতিকতার লড়াই বেগবান করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

লেখক : এম এ কবীর, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 1557
  • Total Visits: 1396540
  • Total Visitors: 4
  • Total Countries: 1675

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ মঙ্গলবার, ১৭ই ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং
  • ৩রা পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (শীতকাল)
  • ১৪ই জমাদিউস-সানি, ১৪৪৬ হিজরী
  • এখন সময়, দুপুর ১২:৫২

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
      1
16171819202122
23242526272829
3031     
15161718192021
293031    
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018